07 । বাংলাদেশের পোশাক শিল্প । Garment industry of Bangladesh ।। প্রবন্ধ-রচনা ।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প।

ভূমিকা :

''বাংলার মসলিন বোগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন তুলেই কিনতেন একদিন''

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এ পঙক্তিদ্বয় প্রাচীন বাংলার পোশাক শিল্পের ব্যাপক চাহিদার কথাই ঘোষণা করে। কিন্তু বেনিয়া ব্রিটিশদের চক্রান্তে সাময়িকভাবে তা থেমে গিয়েছিল। আবার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ শিল্পই বৃহদায়তন শিল্প হিসেবে স্বদেশের চাহিদা মিটিয়ে আজ বিদেশেও বর্তমান। ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে এর রপ্তানির পরিমাণ। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ খাতের অবদান বেশ উৎসাহজনক।

গোশাক শিল্পের অতীত ও বর্তমান অবস্থা : তৈরি পোশাক বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হিসেবে স্বীকৃত। তবে স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে পোশাক শিল্প খাত সম্পর্কে ব্যবসায়ী মহলে তেমন কোন উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল না। এদেশে মূলত ১৯৭৬ সাল থেকে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু। ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মত তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু হয়। ৮০'র দশকে এ খাত বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করে। বর্তমানে এ খাত দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং মহিলা শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী সর্ববৃহৎ খাত হিসেবে চিহ্নিত। এ শিল্পে কর্মসংস্থানও ১০ হাজার থেকে বেড়ে ১৫ লাখে উপনীত হয়েছে। ফলে এ খাত গড়ে প্রতি বছর ২১.৫৩ শতাংশ হারে অর্জন করে চলেছে। দ্রুত বিকাশমান এ খাত থেকে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৭৫% অর্জিত হচ্ছে।

পোশাকের বাজার : বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ২০টিরও অধিক দেশে পোশাক রপ্তানি করছে। তন্মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম ক্রেতা। শুধু এ দেশ থেকেই পোশাক রপ্তানি করে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫৬% অর্জিত হয়। দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তথা জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালি, কানাডা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ ই.ই.সিভুক্ত দেশসমূহ। পোশাক শিল্পে বর্তমানে প্রায় ৮৪টি ক্যাটাগরি আছে। তন্মধ্যে বাংলাদেশ ৩৬টি ক্যাটাগরি উৎপাদন করে থাকে, যার মধ্যে ১৮টি ক্যাটাগরি কোটাভুক্ত এবং বাকি ১৮টি ক্যাটাগরি কোটা বহির্ভূত।

অর্থনীতিতে অবদান : দেশের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি বিশেষ করে মহিলা শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে পোশাক শিল্প দেশের সার্বিক শিল্পায়নে গতি সৃষ্টি করেছে। এ শিল্পের দ্রুত ক্রমবর্ধমানতার কারণে দেশে একদল উদ্যোক্তা শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে যারা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে। এ শিল্পে বর্তমানে প্রায় ৭ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। ফলে জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশের অর্থনৈতিক যোগান দিচ্ছে পোশাক শিল্প যার ফলশ্রুতিতে 'মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় বিবিধ দ্রব্যসামগ্রী, যেমন – প্রসাধনী, জুতা, খাদ্য ইত্যাদির বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। এ - শিল্পের একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে তরল অর্থ। তাই ব্যাংকিং ব্যবসায়ে ক্রমশ খুলে যাচ্ছে এ বিস্তৃত দ্বার। এ শিল্পের বিকাশের কারণে সড়ক ও বিমান পথের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল দিগন্তের। বর্তমানে অনেক স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান পোশাক শিল্পের সহায়ক শিল্প যেমন কার্টুন, সুতা, পলিব্যাগ, লেবেল, নেকবোর্ড - ইত্যাদি উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে উন্নতির ছোঁয়া লাগছে যা নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের জন্য ইতিবাচক।

পোশাক শিল্পের সমস্যা : বর্তমানে ১০০% রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প পড়েছে 'গভীর সংকটে। গার্মেন্টস শিল্পে এ অনিশ্চিয়তা প্রথমত শুরু হয় ২০০৫ সাল থেকে এমএফএন কার্যকরী ও জিএসপি বন্ধের সিদ্ধান্তে। এর ফলে গোটা শিল্পে নেমে আসে হতাশার ছায়া। ব্যবসায়ীরা হয়ে পড়েন উদ্বিগ্ন। তাছাড়া ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে হামলার প্রেক্ষিতে অর্থনীতির দীর্ঘস্থায়ী মন্দা, বাজার সংকুচিত হওয়া, পণ্যমূল্য কমে যাওয়া, সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা না পাওয়া ইত্যাদি কারণে গার্মেন্টস শিল্প এখন নিশ্চিত বিপর্যয়ের মুখে।

আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের মূল্য নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। বাজারে প্রবল প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন ওভেন পোশাকের মূল্য কমে গেছে। বর্তমান অবস্থায় সচল কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৩০ শতাংশ এখন কাজে লাগাতে পারছে। তাছাড়া আগে যেখানে কাপড় কাটা ও সেলাই চার্জ ছিল ৫ থেকে ৬ ডলার, সেটি এখন ৩.৫ থেকে ৩.৪ ডলারে নেমে গেছে। এসব কারণে গত দশ বছরের মধ্যে গত অর্থবছরে নিট শিল্প রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রার ৪.২ শতাংশ এবং আগের বছরের (২০০০-০১) চেয়ে ৬.৩ শতাংশ কম।

গার্মেন্টস শিল্পে অপচয়ও একটি বড় সমস্যা। অদক্ষতা এবং অপচয় রোধ করার মত কারিগরি জ্ঞানের অভাবে এসব শিল্প কম মূল্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মার খেয়ে যায়। অথচ উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে অপচয় কমিয়ে আনতে পারলে পণ্যমূল্য কমিয়েও বাজার ধরে রাখা সম্ভব।

সময়মত জাহাজীকরণ না হওয়া এবং লিড টাইম বেশি হওয়াও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের একটি ব্যয়বহুল বন্দর। এ ব্যয় বহনে ব্যবসায়ীরা কুণ্ঠিত। শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া ৩৭টি সাব-সাহারা ও ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্র সাত দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারলেও বাংলাদেশের লাগে ১২০ দিন।

এসব সমস্যার কারণেই বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে গোটা শিল্পে। ৭৫ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় অর্জনকারী পোশাক শিল্প আজ অনিশ্চয়তার মুখে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব মতে, গত ২০০১-০২ অর্থবছরের আগের বছরের তুলনায় নিট ও হোসিয়ারী পোশাকের প্রতি এককে মূল্য কমেছে ১৯.২ শতাংশ, ওভেনের মূল্য কমেছে ১৩.৮ শতাংশ। ফলে সামগ্রিকভাবে গত অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় নিট ও হোসিয়ারী পণ্য ২.৪৭ শতাংশ এবং ওভেন পোশাকের ৭.১১ শতাংশ রপ্তানি কমে গেছে।

সমস্যা সমাধানের উপায় : বর্তমানে এই অনিশ্চয়তা থেকে আমাদের উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। সরকারি নগদ সহায়তার ১০০ ভাগ অবমুক্তকরণ এবং তা সময়মত উদ্যোক্তাদের হাতে পৌঁছাতে হবে। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে তুলা, সুতা ও বস্ত্র উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উদ্যোগ নিতে হবে। বাণিজ্যনীতি ও শিপিং খাত সংস্কার কর হবে। সার্ক কিউমুলেশন বাস্তবায়ন ও দেশে সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যার হাউস চালু করতে হবে। পণ্যের মান বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় কমিয়ে পণ্যমূল্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। কারিগরি জ্ঞান ও বাণিজ্য নেগোসিয়েশনের দক্ষতা বাড়াতে হবে। কোটা বরাদ্দ কমিটিতে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সরকারি প্রতিনিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নগদ সহায়তা সংক্রান্ত রীতি-নীতি শিল্প উদ্যোক্তাদের অনুকূলে নিয়ে আসতে হবে। লিড টাইম কমিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গার্মেন্টস শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। রুগ্ন শিল্প পুনরুজ্জীবনে সহায়তা ● এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সর্বোপরি, রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ অর্জনকারী এ শিল্পের এখন প্রয়োজন সার্বিক সংস্কার। সরকার, উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে যদি সময় মত সিদ্ধান্ত না নেন তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এটিও পাট শিল্পের মত হারিয়ে যেতে পারে।

উপসংহার : গুণগত মান দিয়ে বিশ্ব বাজারে স্থান করে নেওয়া পোশাক শিল্প বর্তমানে ‘রপ্তানি চালি ‘প্রবৃদ্ধি’ অর্জনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। ১৯৭৮-৭৯ সালে যেখানে এ শিল্পের অবদান ছিল ১৬ লক্ষ টাকা, সেখানে ১৯৯৮-৯৯ সালের এ শিল্পের অবদান দাঁড়ায় প্রায় ১৪,৩৪৬.৯১ কোটি টাকায়। রপ্তানি আয়ে এ বিশাল অবদানের জন্য এ শিল্পকে “বিলিয়ন ডলার শিল্প” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। সুতরাং পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সকল মহলের সহায়তা একান্ত প্রয়োজন।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post