08 । ডেঙ্গুজ্বর । Dengue fever ।। প্রবন্ধ-রচনা ।

ডেঙ্গুজ্বর।

ভূমিকা : মানবদেহে ডেঙ্গুভাইরাসের আক্রমণ জনিত ক্ল্যাসিক্যাল বা হেমোরেজিক ধরনের তীব্র জ্বরের নামই ডেঙ্গুজ্বর। সম্প্রতি বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। আর এ রোগের বাহক হচ্ছে ‘এডিস' নামক এক ধরনের বিশেষ মশা। যদিও এদেশে ডেঙ্গুজ্বর বিষয়ে বেশি বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তবুও ভয়ের তেমন কারণ নেই। এর প্রতিকার এবং প্রতিরোধ অনেকটা সহজ এমনকি নিশ্চিত।

এডিস মশার পরিচয় : এডিস মশা দেখতে গাঢ় নীলাভ কালো রঙের। এ মশার সারা শরীরে সাদা-কালো ডোরা কাটা দাগ আছে, পাগুলো একটু লম্বাটে ধরনের। এডিস ইজিপটাই এবং এডিস এলবোপিকটাস নামক এ দুই প্রজাতির স্ত্রী মশা মূলত, ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাস বহন করে থাকে।

এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। বিশেষ করে সকাল বেলার প্রথম দিকে ও বিকেল বেলার শেষ দিকে এ মশা বেশি কামড়ায়। এডিস মশা মানুষের তৈরি মাটির ও চিনামটির পাত্র, পড়ে থাকা টায়ার, চিপস-এর প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদিতে ডিম পাড়ে।

ডেঙ্গুজ্বরের উদ্ভব ও বিস্তার : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুভাইরাস প্রথম সনাক্ত করা হয়। ১৯৪৪ সালে ডঃ আলবার্ট মার্টিন ডেঙ্গু ভাইরাস আবিষ্কার করেন। তখন বলা হয় দু'জাতির এডিস মশা দ্বারা ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায়। এর একটি হল এডিস এজিটপটাই। অন্যটি হল এডিস এবলোপিপটাস। বাংলাদেশে ১৯৬৪ সনে থাইল্যান্ডের একদল বিশেষজ্ঞ প্রথম ডেঙ্গুজ্বর সনাক্ত করে। তারা ‘ঢাকাইয়া জ্বর’ নামে পরিচিত জ্বরকে ডেঙ্গুজ্বর বলে আখ্যায়িত করে। বিশ্বের অনেক দেশের মত প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ও বার্মাতেও ডেঙ্গুজ্বর দেখা দেয়।

ডেঙ্গুজ্বরের প্রকারভেদ : ডেঙ্গুজ্বর এডিস মশাবাহিত এক ধরনের আর এন এ ফ্ল্যাবি ভাইরাসজনিত তীব্র জ্বর। ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত দু'ধরনের হয়ে থাকে। যথা ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর ও হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর। ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- DEN-1, DEN-2, DEN- ৩, ও DEN- ৪। এই ৪টি সেরোটাইপ থেকে ডেঙ্গুজ্বর হতে পারে। তবে এগুলোর মধ্যে মারাত্মক DEN- ২, DEN-৩। এ দুটি সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাসই হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বরের কারণ।

জ্বরের উপসর্গ : ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে যে সকল উপসর্গ দেখা যায়, সেগুলো হচ্ছে- তীব্র জ্বর, জ্বর সাধারণ ১০৪/১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। বমি, পেটব্যথা ও মাথাব্যথা, কোমর ব্যথা, অস্থিসন্ধি বা জয়েন্ট ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে হাড় ব্যথা এতটাই প্রচণ্ড হয় যে, মনে হয় হাড় ভেঙ্গে গেছে। এ কারণে এই জ্বরকে 'ব্রেক বোন ফিভার’ বলা হয়ে থাকে। অনেক সময় শরীরের ত্বকে এলার্জি র‍্যাশের মত র‍্যাশ দেখা দিতে পারে। এ র‍্যাশগুলো কখনও কখনও চুলকানির উদ্রেক করে থাকে।

হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গগুলোই এক্ষেত্রে আরও তীব্র হয়ে দেখা দেয় এবং সঙ্গে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। বিশেষ করে মাড়ি বা নাক দিয়ে রক্তপাত, ত্বকের নিচের জমাট বাঁধা রক্তের নমুনা, রক্তবমি, পায়খানার সাথে কালো রক্ত যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিয়ে থাকে। রক্তক্ষরণের ফলে হাইপোভলিউমিক শকে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে তাকে। এ অবস্থাকে বলা হয় ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।

ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা পদ্ধতি : ডেঙ্গুজ্বরের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। ক্লাসিক্যাল এবং রক্তক্ষরা বা হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর উভয় ক্ষেত্রেই চিকিৎসা উপসর্গ অনুযায়ী করতে হবে।

১। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত ৭ দিনের মধ্যে সেরে যায়। এ ক্ষেত্রে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়। যেমন- ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, বমির জন্য স্টিমিটিল জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়। এ ছাড়া ডেঙ্গুজ্বরে প্রচুর পানি পান করতে হয়।

২। হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। প্রতিদিন রোগীর রক্তের প্লেটলেট কাউন্ট এবং পি সি ভি পরীক্ষা করাতে হবে। হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বরে রোগীর প্লেটলেট কাউন্ট কমে যেতে পারে। প্লেটলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নেমে গেলে রোগীকে শিরাপথে প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন করতে হবে। আর যদি রোগীর প্রত্যক্ষ রক্তক্ষরণ হয়, তাহলে রোগীকে রক্ত দিতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর ব্যথার জন্য এসপিরিন জাতীয় ওষুধ দেয়া যাবে না। কারণ, এতে রক্তক্ষরণের প্রবণতা বেড়ে যায়।

প্রতিরোধ : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে আমাদের প্রধান করণীয় হচ্ছে চিকিৎসকের সাহায্য নেয়া এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এজন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে- (১) এডিস মশা ডেঙ্গুজ্বরের বাহক, তাই বাহক মশার দমনই হচ্ছে ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের প্রধান উপায়। (২) বাসগৃহ, ফুলের টব, অব্যবহৃত কৌটা, ড্রাম, নারিকেলের মালা, গাড়ির টায়ার, ইত্যাদিতে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এসব পানি জমার স্থান ধ্বংস করতে হবে। (৩) ঘরে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। (৪) এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনের বেলায় ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে। (৫) 'ডেঙ্গু’ সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

প্রতিষেধক আবিষ্কার : মানুষের অনেক অসাধ্যই বিজ্ঞান সাধন করে দিয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর যুগে ডেঙ্গুজ্বরের কোন প্রতিষেধক না থাকা সত্যি লজ্জার বিষয়। বিশ্ববাসীর এ লজ্জা ঘুচিয়ে দিতে গত কিছু দিন আগে আশার বাণী শুনাল ডায়রিয়া রোগের আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবি। আইসিডিডিআরবি’র প্রোগ্রাম অন ইনফেকসাস ডিজিজ এন্ড ভেকসিন সায়েন্স-এর প্রধান রবার্ট এফ ব্রেইমেন জানিয়েছেন, আগামী ১ বছরের মধ্যেই ডেঙ্গুজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কার সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রতিষেধক আবিষ্কার হলে ডেঙ্গু আর সব সাধারণ রোগের মতই একটি হিসেবে বিবেচিত হবে।

উপসংহার : বর্তমানে নতুন আতঙ্ক ডেঙ্গুজ্বরের কালো থাবা ছিনিয়ে নিয়েছে অনেক জীবন। যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সফলতার যুগে কারোরই কাম্য নয়। তবুও রোগ আসে, নিয়ে যায় জীবন। তাই ডেঙ্গুজ্বরের কারণে আর কোন অমূল্য জীবন যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post