09 । বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ । Fisheries resources of Bangladesh ।। প্রবন্ধ-রচনা ।

বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ।

ভূমিকা : প্রবাদ আছে, মাছে ভাতে বাঙালি। এক সময় মাছ ও ভাতই ছিল বাঙালির প্রধান খাদ্য। এখনও আছে, তবে দারুণ অভাব। প্রয়োজনের তুলনায় মাছের সরবরাহ কমেছে অনেক। মাছের এই অভাব সত্ত্বেও মাছ এখনও আমাদের অন্যতম প্রাণীজ সম্পদ। আমাদের মৎস্যখাত দেশের দুর্বল অর্থনীতিতে এখনও প্রাণ রসায়ণের যোগানদার এবং একটি সম্ভাবনাময় নির্ভরযোগ্য খাত।

বাংলাদেশে মাছের উৎস : বাংলাদেশ জলসম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। বাংলাদেশে মাছের উৎসকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা -

(১) মিঠা পানির উৎস : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে ছোট-বড় প্রায় ২৩০টি নদী রয়েছে। এছাড়া অসংখ্য খাল-বিল, ঝিল-ডোবা রয়েছে এখানে। রয়েছে হাজার হাজার হাওড়-বাঁওড়, পুকুর-দিঘি। এ সবই মিঠা পানির মাছের উৎস। দেশে প্রায় তের লাখ পুকুরের সাড়ে তিন লাখ একর জলাশয়, প্রায় দশ হেক্টর নদী অঞ্চল, কাপ্তাই হ্রদসহ প্রায় দুই লাখ হেক্টর বিল ও হ্রদ অঞ্চল ছাড়াও বন্যায় ডুবে যাওয়া প্রায় ২৮ লাখ হেক্টর জমিতে মাছ জন্মায়। দেশে ধৃত মাছের শতকরা ৬০ শতাংশ আসে নদী থেকে। মিঠা পানির মাছের মধ্যে রয়েছে কৈং, সিং, মাগুর, পুঁটি, রুই, কাতলা, বোয়াল, নলা, শোল ইত্যাদি।

(২) লোনা পানির উৎস : বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে প্রায় সাতশ কি.মি. দীর্ঘ উগকূল সংলগ্ন বিশাল মৎস্য অঞ্চল। নদীর মোহনা, উপকূল ও গভীর সমুদ্রের লোনা জল সামুদ্রিক মাছের পর্যাপ্ত বিচরণ ক্ষেত্র। সেখানে সারা বছর নানা জাতের মাছ পাওয়া যায়। লোনা পানির মাছের মধ্যে রয়েছে রূপচান্দা, ছুড়ি, পোয়া মাছ ইত্যাদি।

(৩) মৃদু লোনা পানির উৎস : বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, চকোরিয়া, কক্সবাজার উপকূলের প্রায় এক লাখ হেক্টর পরিমাণ জমির মৃদু লোনা পানিতে চিংড়ি ও ভেটকি মাছের চাষ করা হয়ে থাকে।

মৎস্য সম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব : বাংলাদেশের প্রায় ১.২ কোটি জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের উপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে ১২.০ লক্ষ লোক সার্বক্ষণিকভাবে মৎস্য সেক্টরে নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশের সকল জনগোষ্ঠীর প্রাণীজ আমিষের চাহিদার ৬০ ভাগ যোগান আসছে মাছ থেকে। বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক প্রায় ২০ গ্রাম মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এতে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন। বিদেশে মাছ রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। জাতীয় আয়ের প্রায় ৫% এবং রপ্তানি আয়ের ১০% আসে মৎস্য খাত থেকে। এছাড়া মৎস্যজাত বিভিন্ন পণ্যেরও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। সার্ডিন ও হাঙ্গরের তেল রঙ উৎপাদনে এবং ইস্পাত ও পাট উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাজে লাগে। চামড়া মোলায়েম করার কাজে এই তেল বিশেষ ভূমিকা রাখে। গ্লিসারিন, মোম ও সাবান শিল্পের কাঁচামাল আসে মৎস্য সম্পদের উপজাত থেকে। বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্য তৈরিতে ও মাছের উপজাত কাজে লাগে। বিভিন্ন মাছ থেকে পাওয়া তেল থেকে প্রাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ রোগ নিরাময় ও রোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়। পশু পালনের ক্ষেত্রে খাদ্য হিসেবেও বিভিন্ন মাছের ব্যবহার রয়েছে। অতিরিক্ত প্রোটিন খাদ্য হিসেবে এগুলো হাঁস-মুরগি জাতীয় প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে বিশেষ উপযোগী।

মাৎস্য খাতে বিরাজমান সমস্যা : বাংলাদেশে নানা কারণে মাছের অভাব দেখা দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য কারণগুলো নিম্নরূপ :

১। মাছের ভবিষৎ বংশ বিস্তারের কথা না ভেবে মাত্রাতিরিক্ত মৎস্য আহরণ করা এবং জলাশয় থেকে সম্পূর্ণ পানি নিষ্কাশন করে সকল মৎস্য আহরণ করা।

২। অতিরিক্ত পলি জমে এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ এর ফলে মৎস্য আবাস ভূমির সংকোচন।

৩। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের অপরিশোধিত বর্জ্য নিক্ষেপ, ফসলের জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, মৎস্য কুলের প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি ও বংশ বৃদ্ধির উপর বিরূপ প্রভাব।

৪। খাল-বিল-ডোবা-পুকুর ইত্যাদি চাষাবাদে কিংবা জলসেচের জন্য ব্যবহার করায় মাছের বিচরণ ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে।

৫। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে শুকনো মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এবং চাষাবাদের জন্য গভীর নলকূপ খননের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বাংলাদেশে খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলেও মাছের বিচরণ ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে।

৬। ডিমওয়ালা মাছের অনভিপ্রেত শিকারের ফলে মাছের বৃদ্ধি রোধ হচ্ছে। জাটকা মাছ শিকারের ফলেও মাছের উৎপাদন কমছে।

৭। থাইল্যান্ড, মায়ানমার প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশ উপকূলবর্তী সমুদ্রে ব্যাপকভাবে দস্যুতায় লিপ্ত হওয়ায় আমাদের মৎস্য সম্পদের ঘাটতি বাড়ছে।

৮। পরিবেশের বিবর্তন, জলাশয়ের সংকোচন ও মানব সৃষ্ট নানাবিধ সমস্যার কারণে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে।

মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের উপায় : মৎস্য বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় শিল্প। এই খাতে উন্নয়নের সুযোগও যথেষ্ট। দেশে মাছের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো এবং এই খাতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হলে মৎস্য সম্পদ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।

১। জলসেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা নর্দমার উদ্দেশ্য ব্যতীত নদী-নালা, খাল এবং বিলে অস্থায়ী বা স্থায়ী বাঁধ বা কোনরূপ অবকাঠামো নির্মাণ না করা।

২। নদ-নদী, খাল-বিলে স্থায়ী স্থাপনার মাধ্যমে (ফিক্সড ইঞ্জিন) মৎস্য আহরণ না করা, এরূপ ক্ষেত্রে স্থায়ী স্থাপনা সিজ, অপসারণ এবং বাজেয়াপ্ত করা।

৩। বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করে মাছ না মারা এবং অভ্যন্তরীণ জলাভূমিতে বিষ প্রয়োগ, করা। বাণিজ্যিক বর্জ্য বা অন্যবিধ উপায়ে মাছ ধ্বংসের পদক্ষেপ গ্রহণ না করা।

৪। মাছ ধরার ক্ষেত্রে ৪.৫ সেন্টিমিটার বা তদপেক্ষা কম ব্যাস বা দৈর্ঘ্যের ফাঁস বিশিষ্ট ফাঁসজাল (প্রচলিত নাম কারেন্ট জাল) এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।

৫। উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ ও চিংড়ি পোনা আহরণ নিষিদ্ধ করা।

৬। মাছচাযী বা উদ্যোক্তাদের সহজশর্তে ঋণ প্রদানের জন্য মৎস্য ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকে পৃথক মৎস্য সেল খোলার ব্যবস্থা গ্রহণ।

৭। প্রজনন মাছ এবং পোনা মাছ চলাচলের পথ উন্মুক্ত রাখা এবং মুক্ত জলাশয়ে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা।

৮। মৎস্য সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে সময় উপযোগী করা এবং কঠোরভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থাকরণ।

মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ : বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যেমন য়মনসিংহে স্বাদুপানি মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র, চাঁদপুরে নদী মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র, বাঙামাটিতে লোনা পানি মৎস্য কেন্দ্র, খুলনায় সামুদ্রিক মৎস্য কেন্দ্র ও কক্সবাজারে মৎস্য প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। কুমিল্লায় স্থাপন করা হয়েছে কৃত্রিম মৎস্য প্রজনন খামার। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছে মৎস্য পোতাশ্রয়। ঢাকা, খুলনা ও কক্সবাজারে মৎস্য অবতরণের জেটি, হিমাগার, বরফ কারখানা স্থাপনসহ কয়েকটি আধুনিক পাইকারী মৎস্য বাজার স্থাপন করা হয়েছে। এসব গ্রহণের ফলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছের চাষ, মাছ সংরক্ষণ, সরবরাহ ও উৎপাদন ইত্যাদিসহ সামগ্রিকভাবে মৎস্য খাতে অগ্রগতি সূচিত হয়েছে।

উপসংহার : বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতির আওতায় মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সারা দেশে মৎস্য সম্পদ রক্ষা ও মাছ চাষে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ব্যাপক উদ্দীপনা ও জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। আশার বাণী হল সরকার এজন্য প্রতি বছর মৎস্য পক্ষ পালনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে এই পক্ষ পালন যেন নিছক আনুষ্ঠানিকতা ও সভা-সেমিনারের মধ্যে সীমিত না হয়ে যায়। এর তাৎপর্য সাধারণ মানুষের উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পারলে রূপালি সম্পদ হবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post