পুস্তক পাঠের আনন্দ।
অথবা, বই পড়ার আনন্দ।
অথবা, জ্ঞান চর্চায় পুস্তক পাঠের ভূমিকা।
ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব। সে প্রতিনিয়ত অন্যের সঙ্গ ও সান্নিধ্য কামনা করে আসছে। মানুষের সঙ্গ লাভের এ প্রবৃত্তি কেবল মানুষকে কেন্দ্র করেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। যুগ যুগ ধরে সে গ্রন্থের সঙ্গও কামনা করে আসছে। মানুষ তার আত্মার আত্মীয়ের তথা বিশ্ব মানবের সাহচর্য ও সঙ্গ লাভ করে গ্রন্থের মাধ্যমে। অনাদিকাল থেকেই গ্রন্থ পাঠে মানুষ অনাবিল শান্তি লাভ করে আসছে।
গ্রন্থ পাঠের উপকারিতা : গ্রন্থ পাঠে মানুষের মনে আসে আনন্দ-বেদনার কাব্যিক দার্শনিক সত্যবোধ। গ্রন্থ পাঠের প্রভাবেই মানব জীবন সুন্দর ও নিখুঁত থাকে। গ্রন্থ পাঠই আমাদের মনে এনে দেয় নতি, সহানুভূতি, মায়া-মমতা ও প্রেম প্রীতি। যুগে যুগে গ্রন্থ এনেছে ত্যাগের দীক্ষা, সত্য ও সুন্দরের সাধনা। ইতিহাস, স ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি গ্রন্থ পাঠ করে মানুষ মেটাচ্ছে তার মনের ক্ষুধা। গ্রন্থ পাঠ মানুষের দৃষ্টিকে করে উদার, মনকে করে উন্নত। দুঃখ-কষ্ট, শোক-তাপ, হতাশা-অবসাদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীতে গ্রন্থ পাঠেই মানুষ আনন্দ লাভ করতে পারে।
গ্রন্থ পাঠে আনন্দ/ আনন্দ কেন : মানুষের আনন্দ লাভের পথ বহু বিচিত্র। গ্রন্থ পাঠ আনন্দ লাভের শ্রেষ্ঠ পথ। এটা আমাদের নানাভাবে আনন্দ দান করে থাকে। এটি কর্মক্লান্ত দিনের ব্যস্ততা ও হানাহানির মধ্যে ক্লিষ্ট—পীড়িত চিত্তের ক্লান্তি দূর করে এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি। এটা মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে কাজ করে। জীবনের নানাবিধ অভিঘাত আমাদেরকে যখন উন্মাদ করে তোলে তখন আমরা সান্ত্বনা, সহানুভূতি ও আনন্দের জন্য ছুটে চলি গ্রন্থাগারের দিকে। গ্রন্থই দুঃখ-বেদনায় এনে দেয় বিশুদ্ধ মত্ততা।
বিশ্বের সাথে যোগাযোগের উত্তম উপায় গ্রন্থপাঠ : গ্রন্থের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি। সমগ্র বিশ্বকে জানতে হলে গ্রন্থ পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য সাধনার নীরব সাক্ষী বিশ্বের অজস্র গ্রন্থ। উন্নত ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার সাথে রাখীবন্ধন স্থাপন করে গ্রন্থ পাঠ। এটা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতু গড়ে তোলে। অতীতের ঐতিহ্য, নানা সৎ চিন্তার অনুশীলন ও বিচিত্র ভাবধারা নিহিত রয়েছে গ্রন্থরাজিতে। তাই বিচিত্র জাতি, দেশ ও সমাজের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য গ্রন্থের সাহায্য ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ প্রসঙ্গে কবি গুরু যথার্থই বলেছেন—
“বিশাল বিশ্বের আয়োজন
মন মোর জুড়ে থাকে অতিক্ষুদ্র তারি এক কোণে,
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে অক্ষয় উৎসাহে।”
বইয়ের বৈচিত্র্য : সভ্য মানুষের প্রয়োজন অসংখ্য গ্রন্থরাজির সান্নিথ্য ও সঙ্গ। বিচিত্র বইয়ের বাহারি বৈচিত্র্য থেকে মানুষ আনন্দের নির্যাস পান করে। ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি বইয়ের পাতায় পাতায় মিশে আছে বিভিন্ন জাতির জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যের স্রোতধারা। সে ধারার মোহনায় সঙ্গম ঘটাতে পারলেই মানুষের আত্মপ্রসার ঘটে। তাই রুচিশীল বই বেছে নিয়ে পাঠ করতে হবে।
পাঠকচিত্তে গ্রন্থপাঠের প্রভাব : গ্রন্থ প্রভাব পাঠক চিত্তে একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে। মহাকবি গ্যায়টে পাঠের মাধ্যমেই আনন্দ খুঁজে পেতেন। পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম নিভৃতে বৃক্ষতলে স্বর্গ রচনার জন্য উপকরণের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন, তাতে একখানি কাব্যেরও স্থান ছিল। তাঁর মতে, গ্রন্থ ছাড়া স্বর্গীয় আনন্দ অপূর্ণ থেকে যায়। তিনি বলতেন, “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কাল চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে; কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়।”
সাহিত্য পাঠে মনীষীর উক্তি : সংসারের দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা, অবসাদ মানুষের মনকে যখন বিষিয়ে তোলে তখন গ্রন্থ পাঠই হয়ে উঠে শান্তির উৎস। কোন একজন মনীষী বলেছেন, ‘‘সাহিত্য অমৃতায়মান শান্তির উৎস। শক্তির কল্পফলের রস।'’ তাই, এ চির আধি-ব্যাধি বিজড়িত, কর্ম তাপ-তপ্ত নিরাশা তুহিনাচ্ছন্ন সংসারে যে জাতি এ অমৃত পান করে, সে মরণ তন্দ্রার মধ্যেও বেঁচে ওঠে, অবসাদের মধ্যেও শান্তি পায়। মাতৃদুগ্ধের অমৃত ধারা মাতৃভাষার মধ্যে সঞ্চারিত আছে। তাই মাতৃভাষার সাহিত্যে যে ভাব প্রবাহ ছোটে তা জাতির প্রাণের মধ্যে স্পন্দন জাগায়। প্রত্যেক শোণিত বিন্দু চঞ্চল ও অধীর করে তোলে। সাহিত্য প্রাণের ভাষায় প্রাণের কথা কয়। তাই প্রাণে প্রাণে প্রেরণা ছুটায়।
উপসংহার : গ্রন্থ পাঠে মানুষ আনন্দ লাভ করে থাকে সত্য, তবে আনন্দ উপলব্ধির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। গ্রন্থের জগৎ থেকে আনন্দ লাভের জন্য মানুষকে অধ্যবসায়ী হতে হবে। উৎকৃষ্ট গ্রন্থই মানুষকে প্রকৃত সুখ ও আনন্দ দান করতে পারে। গ্রন্থ পাঠের আনন্দ দীর্ঘদিন মানুষের মনকে সুরভিত করে রাখে।