দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার।
অথবা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
ভূমিকা : দৈনন্দিন জীবন ধারণের জন্য আমাদের অসংখ্য উপকরণের প্রয়োজন। এদের মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জীবন ধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে জনজীবনে সৃষ্টি হয় এক অস্বস্তিকর অবস্থা। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আমাদের সামাজিক, জাতীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে এক বিরাট সমস্যা ।
দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার সাথে জীবনযাত্রার সম্পর্ক : দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার সাথে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ও সুখকর। কেননা দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকলে মানুষ তাদের সীমিত আয় দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সাংসারিক ব্যয় পরিচালনা করতে পারে। শুধু তাই নয় মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি সুবিধা পর্যাপ্তভাবে পাওয়া যায় দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার ফলশ্রুতিতেই। নানা কারণে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটলে জীবনযাত্রায় এক অপ্রত্যাশিত বিশৃঙ্খলা ও অস্বাভাবিকতা নেমে আসে। ফলে জনজীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তাই একটি স্বাভাবিক, পরিকল্পিত ও দুশ্চিন্তা মুক্ত জীবন ব্যবস্থা পরিচালনায় দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
জনজীবনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া : নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে জনজীবন আজ সংকটের সম্মুখীন। এগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ ও মহামারী প্রধান। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ অভাবের তীব্রতা ও শোচনীয় দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। তারা দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পেতে কখনও ধর্মঘট করে আবার কখনও বা বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনে নামে। তাদের আন্দোলনের মুখে সরকার সামান্য বেতন বৃদ্ধি করলেও মূল্য বৃদ্ধির দুর্বার ও আগ্রাসী শক্তির সাথে তারা সামঞ্জস্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। এদের মধ্যে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মুনাফালোভী মজুতদার, মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পণ্যের ওপর কর আরোপ ইত্যাদি প্রধান। সাধারণত পণ্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয় না হলে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। এরূপ পরিস্থিতিতে কিছু মুনাফালোভী মজুতদার পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে বাজারে পণ্যের যোগান হ্রাস পায়। তাই উৎপাদন স্বল্পতার কারণে স্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অনেক সময় দেশের এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সময় পণ্যের উৎপাদন স্থল থেকে চাহিদা অঞ্চলে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ফলে সরবরাহের স্বল্পতাহেতু ণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় সরকারি নিয়ন্ত্রণের শিথিলতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের মজুদ বৃদ্ধি করে। ফলে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম ঘাটতিজনিত কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। মাঝে মাঝে দেখা যায় দেশের অর্থনৈতিক ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার অতিরিক্তি মুদ্রা বাজারে ছাড়ে। ফলে সম্পদের তুলনায় টাকার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়। এরূপ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় হরতাল, অবরোধ প্রভৃতি কর্মসূচি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কল-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। আবার রাজস্ব বাজেটে করারোপিত পণ্যের আমদানি খরচ বেশি হয় বলে ঐ সমস্ত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষতিকর দিক : বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে জনগণের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতি থাকে না। ফলে জনজীবনে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় এবং দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে মুষ্টিমেয় বিত্তবান ছাড়া অধিকাংশ মানুষ নিদারুণ সমস্যায় পড়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাগ্যাহত মানুষকে দ্রব্যের বাড়তি মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে গিয়ে ব্যয়সংকোচন নীতি অবলম্বন করতে হয়। এমনকি তাদেরকে সংসারের অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের খাতও উপক্ষো করতে হয়। এতে সংসারে দুঃখ-দুর্দশা বৃদ্ধি পায়। দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কতিপয় সুযোগ-সন্ধানী অসাধু ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠে। সর্বোপরি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিকার : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আমাদের সামাজিক, জাতীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে এক দুষ্টরাহু। তাই যথাশীঘ্র এই রাহু থেকে মুক্তির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এই উদ্দেশ্যে বাজারে চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। কল-কারখানার উৎপাদন নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি প্রক্রিয়ায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। হরতাল, অবরোধ ইত্যাদিতেও কল-কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখতে হবে। পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে সরকারি ভাণ্ডার থেকে পণ্যের যোগান দিয়ে বাজার দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য মজুতদারি ও কালোবাজারি দূর করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। অসাধু ও ফটকা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাপনার উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে এবং কেউ যেন হঠকারী সিদ্ধান্ত দিয়ে দ্রব্যের মূল্যকে প্রভাবিত করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে শুধু সরকারের একার পক্ষে এর সমাধান দেয়া কঠিনতর ব্যাপার। সরকারের পাশাপাশি সচেতন জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা বিরোধী কার্যক্রম পরিহারই এ সমস্যার আশু সমাধান দিতে পারে।
উপসংহার : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আমাদের একটি জাতীয় সমস্যা। এতে দেশের অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং বাজার ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তাই একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি প্রতিরোধকল্পে আমাদের সকলকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।