হরতাল বা ধর্মঘট।
ভূমিকা : দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হয়ে কর্তব্য থেকে বিরত থাকার নাম ধর্মঘট বা হরতাল। “ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে ঘট” – এ অভিধা থেকে হরতাল বা ধর্মঘট শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু বর্তমানে ‘হরতাল’ – এর অর্থ দাঁড়িয়েছে মানব জীবনের বৈচিত্র্যময় ন্যায্য দাবি দাওয়া পূরণের সাপেক্ষে যানবাহন, হাট-বাজার, দোকান-পাট, অফিস-আদালত ইত্যাদি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধকরণ।
হরতালের উৎপত্তি ও স্বরূপ : হরতাল আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ নয়। পাশ্চাত্যের অন্যান্য ভাল উপকরণের ন্যায় হরতাল একটি কল্যাণমূলক উপকরণ হিসেবে পশ্চিম থেকে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে স্থান করে নিয়েছে। গুজরাটি ‘ধর্মঘট’ শব্দটিকে আমরা ইংরেজি "strike" শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করি। "strike" শব্দের অর্থ ‘আঘাত করা।’ উৎপত্তির উৎস ও অর্থের তাৎপর্য যা-ই হোক না কেন হরতাল নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের প্রত্যক্ষ অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সম্ভবত অর্থের সাথে মিল রাখতে গিয়ে বর্তমানে হরতাল শব্দের কার্যপরিধি দাঁড়িয়েছে জনজীবনে বাধা সৃষ্টি করা, গাড়ি ভাংচুর করা, অগ্নিসংযোগ করা, অফিস আদালত বন্ধ করে দেয়া এবং সর্বোপরি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করার মত হিংসাত্মক কার্যাবলিতে।
হরতালের কারণ : সাধারণত শিল্পপতি বা পুঁজিপতিদের আনুকূল্যের ওপরই নির্ভর করে শ্রমজীবীদের স্বার্থ। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে ক্ষমতার শক্তিতে শোষণ চলে আসছে। তাই অস্তিত্বের প্রশ্ন যখন বড় হয়ে ওঠে তখন বাঁচার জন্য হরতালের আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। দীর্ঘদিন যাবৎ শাসন, শোষণ, জনগণের দাবিকে উপেক্ষা, সহযোগিতা আর সহমর্মিতার অভাব ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট ধূমায়িত অসন্তোষ আর বঞ্চনার হাহাকার একদিন হরতালে রূপ নেয়। নির্যাতিত মানুষের দাবি আদায় হরতালের আদি উদ্দেশ্য হলেও বর্তমানে ‘হরতাল’ এর অর্থ, সংজ্ঞা ও উদ্দেশ্য মানব কল্যাণের পরিবর্তে মানব ক্ষতির দিকটারই প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে কথায় কথায় হরতাল ডাকা হয়, তিলকে তাল করে বন্ধ করে দেওয়া হয় জনজীবনের সচল অবস্থা। বিরোধীদলগুলো জনকল্যাণের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দলকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যেই হরতাল আহবানে মরিয়া হয়ে ওঠে। মূলত বর্তমানে রাজনৈতিক হরতালগুলোর মধ্যে দেশের ও জনগণের উন্নয়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য নেই, নেই দেশ গড়ার সমন্বিত প্রচেষ্টা, তবে রয়েছে ক্ষমতালোভ এবং ব্যক্তি উন্নয়নের মানসিকতা। আবার কোমলমতি শিক্ষার্থী যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে পড়াশোনা করা তারাও বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে কারণে অকারণে হরতাল আহ্বান করছে।
হরতালের সুফল : মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের মানসেই হরতালের উৎপত্তি। কাজেই এর সফলতাকে অস্বীকার করার অবকাশ নেই। সুসংবদ্ধ ধর্মঘট সর্বত্রই জয়ী হয়। হরতাল বা ধর্মঘটের দ্বারা মানুষের অধিকার আদায়ের যৌক্তিক দাবি সম্মানিত হয়, দাবি উত্থাপনকারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সমাজের অস্পৃশ্য শ্রমজীবী মানুষের ওপর নির্যাতন ও অন্যায়ের খডুগ কৃপাণ চালিয়ে পুঁজির পাহাড় গড়ে তোলার মত মানসিকতার গথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে হরতাল বা ধর্মঘট। ধর্মঘট পুঁজিপতিদের অন্যায় ও শোষণের সিংহাসনে কাঁপন ধরিয়ে দেশের জনসাধারণের বৃহত্তর অংশের কল্যাণ সাধনে সমর্থ হয়। তাছাড়া মানুষের মাঝে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলির সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
হরতালের কুফল : হরতালের মাধ্যমে দাবি আদায়ের অব্যর্থ অস্ত্রটি নিঃগৃহীত মানুষের কাছে যতই কল্যণকর বিবেচিত হোক না কেন এর কুফলসমূহ অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এ অস্ত্রের নির্মম আঘাতে দেশের অর্থনীতি আশঙ্কাজনক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হরতালের প্রভাবে আজ কল-কারখানায় তালা ঝুলছে। যার ফলে আমাদের জাতীয় উৎপাদন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্র-ছাত্রীদেরকে স্বাভাবিক পাঠদান করতে পারছে না, যার ফলে দেশের ভবিষ্যৎ মেধা বিনষ্ট হচ্ছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠছে, পরিবহন ব্যবস্থা হয়ে পড়ছে জনবিচ্ছিন্ন। হরতালের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিতিশীলতা যা বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। আর বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার কারণে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। সর্বোপরি বিভিন্ন সংগঠনের আহূত হরতালে প্রতিনিয়তই ঝরে পড়ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ, খালি হয়ে যাচ্ছে মায়ের বুক, স্ত্রী হচ্ছে স্বামী হারা, বোন হচ্ছে ভাই হারা, সন্তান হচ্ছে পিতৃহারা। হরতালের আর একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক কুফল হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি। যার ফলে বাজার অর্থনীতিতে পড়ছে অন্ধকারের কালো ছায়া। সব মিলিয়ে হরতাল মানব মনে শুধু হতাশারই জন্ম দিয়ে থাকে।
প্রতিকার : হরতালের ক্ষতিকর দিকসমূহের কারণে আজ হরতালের বিরুদ্ধে গণজোয়ার উঠেছে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নিয়ামক হরতালের প্রতিকার ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে গণবিবেককে। পুঁজিপতি শাসকশ্রেণী শোষণ আর বঞ্চনার মাধ্যমে ক্রমেই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলবে আর শ্রমজীবীরা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়বে এমনটি হওয়া বিশ্ব মানবতার প্রতি যথার্থই হুমকিস্বরূপ। কাজেই সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মালিক শ্রমিক, শাসক শোষিত উভয়ের সমস্যা পর্যালোচনা করে সমাধানের প্রয়াস নিতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থ বা ক্ষমতাস্পৃহা ত্যাগ করে জাতির বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করতে হবে। মূলত ধর্মঘট বা হরতালকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের মানসিকতা পরিহার করতে পারলেই ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির কল্যাণ আসতে পারে।
উপসংহার : সমাজের নিপীড়িত, নির্যাতিত আর বঞ্চিত মানুষের দাবি আদায়ের অব্যর্থ অস্ত্র হরতাল আজ জনজীবনে দুঃসহ যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেশ জাতি তথা মানবতার স্বার্থে ধর্মঘটের মূল কারণ খুঁজে বের করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান পন্থা বের করাই শ্রেয়তর। আজ জনগণের প্রাণের দাবি “আর হরতাল চাই না, হরতাল দেশকে সর্বস্বান্ত করে।”