সড়ক দুর্ঘটনা ও তার প্রতিকার।
ভূমিকা : জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের রয়েছে বিভিন্নমুখী চাওয়া। আর এসব চাওয়া পাওয়ার সম্মিলন ঘটানোর প্রয়াসেই প্রতিটি সমর্থ ব্যক্তিকে প্রতিদিনই নাস্তা সেরে রাস্তায় নামতে হয় জীবিকার অন্বেষণে। রাতের নীরব রাস্তা সূর্য বাড়ার সাথে সাথে সরব হয়ে উঠে পথিকের ব্যস্ত পদচারণায়, যানবাহনের পথ যাত্রায়। কাজ শেষে সবাই ঘরে ফিরবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু মাঝে মাঝে এই স্বাভাবিকতায় বিঘ্ন ঘটায় সড়কে চলমান যন্ত্র দানবগুলো। এরা অকস্মাৎ ছিনিয়ে নেয় পরিবারের একমাত্র আশা, অন্নবস্ত্রের সংস্থানকারীকে যা কখনোই কাম্য নয়।
লোকসংখ্যা ও যানবাহন বনাম রাস্তা : স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাংলাদেশের সড়ক পথের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ হাজার কিলোমিটার পাকা রাস্তা রয়েছে যার মধ্যে মাত্র ৪০% হাইওয়ে সম্পন্ন। অপরদিকে, এ দেশে শুধু মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ। রিক্সা, ভ্যান, সাইকেল, ঠেলাগাড়ি, অটোরিক্সা ইত্যাদি অগণিত। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উন্নত দেশের তুলনায় এগুলো প্রায় ৩০ গুণ বেশি। কেননা, দেশের বৃহত্তম শহরগুলোতে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বন্যার বেগে ছুটে আসা মানুষ আর যানবাহনের ভিড় ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে' অবস্থা। এ হিসেবে বাংলাদেশের সড়ক পথে অতিরিক্ত যানবাহন চলাচলের ফলে দুর্ঘটনার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।
বাড়ল চাপ যানবাহন আর জনতার
পাল্লা দিয়ে বাড়ল সড়ক দুর্ঘটনার।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ : সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে আমাদের দেশের একটি জাতীয় সমস্যা। নানাবিধ কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অকালে ঝরে পড়ে কিছু তাজা প্রাণ। সাধারণত বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই ঘটে অদক্ষ, অযোগ্য ও লাইসেন্সবিহীন চালকের কারণে। দায়িত্ব-কর্তব্যহীনতাও দুর্ঘটনা ঘটার একটি অন্যতম কারণ। নিজের ও যাত্রীদের জীবনের মায়া না করে প্রায়ই চালকরা মদ্যপ অবস্থায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায় যা দুর্ঘটনার পাশাপাশি কতিপয় লোকের জীবনের যবনিকা আনে। আবার ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল দুর্ঘটনার একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। প্রায়ই ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রাফিক আইন ভঙ্গের মাধ্যমে ওভার টেকিংয়ের ভূত যেন প্রতিটি চালকের ঘাড়ে বিদ্যমান। আর এই জ্ঞান বিবেচনাহীন ওভারটেকিং অধিকাংশ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণ। এছাড়াও, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পথ অবরোধ, পথ সভা, হরতাল প্রভৃতি কারণে যানজট সৃষ্টির ফলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া দুর্ঘটনার প্রতিরোধে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবসহ আরো নানাবিধ কারণ রয়েছে।
দুর্ঘটনার চিত্র : সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে আমাদের দেশে নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে ছিনিয়ে নিচ্ছে মানুষের অমূল্য জীবন, ভেঙ্গে দিচ্ছে অসংখ্য সাজানো সংসার। পত্রিকার পাতা খুললেই আমরা দেখতে পাই দুর্ঘটনার খবর। স্বজন হারা মানুষের আহাজারি, পিতৃহারা সন্তানের আকুতি “আর যেন কোন সন্তানকে এতিম হতে না হয়।” সরকারি হিসাবেই এ সংখ্যা বছরে প্রায় চারশ'। কোথাও বাসের সাথে বাসে, কোথাও বাসে-ট্রাকে, কোথাও টেম্পু-বাসে ঘটে এ দুর্ঘটনা। আবার কোথাও রিক্সা বা নিরীহ পথচারীকে চাপা দেয় দ্রুতগামী বাস বা ট্রাক, কেড়ে নেয় অমূল্য মানব জীবন।
ঢাকার চিত্র : ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগাসিটি। প্রায় দেড় কোটি লোকের তুলনায় এখানে রাস্তা বা রাস্তার বাহন, যানবাহন কোনটাই প্রতুল নয়। আর যেগুলো আছে সেগুলোর বেশিরভাগই জরাজীর্ণ, সংকীর্ণ। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনার পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যা।
ঢাকার বাইরে : তুলনামূলকভাবে ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে দুর্ঘটনার হার কিছুটা কম। দূরপাল্লার বাস, ট্রাকই মূলত এক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হয়। অনেক সময়। ফেরিতে উঠতে গিয়ে অথবা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের গাছে ধাক্কা খেয়ে, অথবা প্রতিযোগিতামূলকভাবে কোন গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে সংঘটিত অসংখ্য দুর্ঘটনা অকালে বিধবার সাজে সাজাচ্ছে কাউকে কাউকে বা করছে এতিম, সহায় সম্বলহীন।
প্রতিকার : সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে বাংলাদেশের একটি জাতীয় সমস্যা। এর ফলে অকালে মা হচ্ছেন সন্তান হারা, স্ত্রী হচ্ছে স্বামী হারা আর সন্তান হচ্ছে পিতৃহারা। তাই আজ গণবিবেক জেগে উঠেছে। আমাদেরকে আজ ভাবতে হচ্ছে এর প্রতিকার ব্যবস্থা নিয়ে। এক্ষেত্রে প্রথমত লাইসেন্স প্রদানের পূর্বে চালকের দক্ষতা ও যোগ্যতা ভালভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। লাইসেন্স বিহীন কেউ যেন গাড়ি চালাতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখাও আবশ্যক। আবার গাড়ি রাস্তায় বের করার পূর্বে এর যান্ত্রিক কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। ট্রাফিক আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দুর্ঘটনা রোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। তাই প্রতিটি চালক এমনকি পথচারীকেও ট্রাফিকের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অতিরিক্ত মাল ও যাত্রীবহন বন্ধ করতে হবে।
শেষ কথন : ‘কুল্লু নাফসিন জায়িকাতুল মাউত’ – প্রতিটি জীবিত প্রাণীকেই মৃত্যুর যাদ ভোগ করতে হবে। আমাদেরও মরতে হবে। কিন্তু নিশ্চয়ই পথের বলি হয়ে কেউ মরতে চাই না। কিন্তু দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে ছিনিয়ে নিচ্ছে মানুষের অমূল্য জীবন, ভেঙ্গে দিচ্ছে তাদের সাজানো সংসার। তাই, সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে আমাদের দেশের একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আজ সর্বমহল থেকে দাবি উঠেছে, “নিরাপদ সড়ক চাই।”