ইন্টারনেট।
অথবা, বিশ্ব যোগাযোগ ও ইন্টারনেট।
ভূমিকা : মানব সভ্যতার কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে বিজ্ঞানের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল সে অগ্রযাত্রা আজ চরম সার্থকতার ছোঁয়া পেয়েছে। শুরু থেকে অদ্যাবধি বিজ্ঞান মানুষকে যা কিছু দিয়েছে তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ইন্টারনেট। এটি মানুষের জীবনে চলার পথকে অভাবনীয় রূপে সহজতর করে তুলেছে। অধুনা যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইন্টারনেট এক যুগান্তকারী বিপ্লব সাধন করেছে। ইন্টারনেটের বাহ্যত তেমন কোন সীমা নেই। এর দ্বারা প্রায় সবকিছুই সম্ভব।
ইন্টারনেট কি : ইন্টারনেট একক কোন বিষয় নয়, এটি একটি জটিল সমন্বিত বিষয়। অসংখ্য নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বব্যাপী বৃহৎ কম্পিউটার নেটওয়ার্কই ইন্টারনেট। অর্থাৎ ইন্টারনেট হল নেটওয়ার্কের নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্কভুক্ত কম্পিউটারগুলোকে অন্যান্য নেটওয়ার্কভুক্ত কম্পিউটারের সাথে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাই ইন্টারনেটের কাজ।
ইন্টারনেটের আদিকথা : পারমাণবিক আক্রমণ প্রতিহত, বৈজ্ঞানিক তথ্য ও অন্যান্য তথ্যাদি বিনিময়ের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট উদ্ভাবন করে। প্রথম দিকে এটি পরিচিত ছিল ‘মিলনেট’ নামে। সামরিক উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট উদ্ভাবিত হলেও সময়ের চাহিদার উদ্দেশ্যে ক্রমান্বয়ে এটি বেসামরিক দিকে মোড় নেয়।
ইন্টারনেটের বিকাশ : সত্তর এবং আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ নেটওয়ার্কের সাথে সম্পৃক্ত হয়। আশির দশকের শেষার্ধে স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস পেলে নেটওয়ার্কগুলো বেসামরিক বা সাধারণ্যে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়। কম্পিউটারেরও সেই সাথে নেটওয়ার্কিং সফ্টওয়্যারের দ্রুত উন্নতির ফলে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা ও প্রসার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় আট কোটির মত কম্পিউটার ব্যবহারকারী ইন্টারনেটের আওতাভুক্ত। এ সংখ্যা দিন দিন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইন্টারনেটে প্রবেশের জন্য যা প্রয়োজন :
ইন্টারনেটে প্রবেশের জন্য মাত্র ৪টি জিনিসের দরকার। এগুলো হল কম্পিউটার, মডেম, টেলিফোন লাইন ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার। এদের কাজগুলো নিম্নরূপ :
কম্পিউটার : কম্পিউটার তথ্যাদি টাইপ করতে সাহায্য করে এবং তা স্বীয় মেমোরিতে রাখে। অতঃপর তা নেটওয়ার্কিং সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে প্রাপকের কাছে তথ্য পাঠানোর প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করে।
মডেম : এটি সাধারণ টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে তথ্যাদি পাঠানোর উপযোগী করতে এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে তথ্যাদিকে ডিজিটাল থেকে এনালগ এবং এনালগ থেকে ডিজিটালে রূপান্তর করার কাজ নিষ্পন্ন করে।
টেলিফোন লাইন : টেলিফোন লাইন তথ্যাদি দ্রুত স্থানান্তর করে। এক্ষেত্রে এনালগ অপেক্ষা ডিজিটাল টেলিফোন তথ্যাদি দ্রুত স্থানান্তর করতে পারে।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার : ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অনেকাংশে পোস্ট অফিসের ন্যায় ভূমিকা পালন করে। এটি এর মক্কেলদের কাছ থেকে মাসিক বা ব্যবহৃত সময়ানুযায়ী নির্দিষ্ট একটা চার্জ নিয়ে তাদের নিজস্ব শক্তিশালী কম্পিউটার ফাইবার, অপটিক্স বা স্যাটেলাইটের (গওইক) মাধ্যমে দেশে বিদেশে অপরাপর ইন্টারনেট সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগে সাহায্য করে।
ইন্টারনেটের উপকারিতা : একবিংশ শতাব্দীর আজকের বিশ্বে ইন্টারনেটের বহুমুখী উপকারিতা বর্তমান। যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ইন্টারনেট চোখের পলকে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্যাদি আদান প্রদান করে থাকে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদিতে এর অবদান অপরিসীম।
ইন্টারনেটের অপকারিতা : ইন্টারনেটের সাহায্যে অনেক ধ্বংসাত্মক কাজ করা সম্ভব। ইদানীং ইন্টারনেটের মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ, পর্ণ ছবি দেখা, জুয়া খেলা ইত্যাদির কালচার বাড়ছে। ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ ‘ইন্টারনেট ওয়ার্ম’ নামক ভাইরাস ঢুকায়। ফলে বহু কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যায়। অন্য একটি ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন তের বছর বয়সী স্কুল ছাত্র তাদের স্কুলে বোমা রেখে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরে তার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। দু' একটা নয়, এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। প্রকৃত বিচারে ইন্টারনেটের কোন অপকারিতা নেই। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর অসৎ উদ্দ্যেশ্যের মধ্যেই এর অপকারিতা নিহিত। ইন্টারনেটের তথাকথিত অপকারিতার জন্য ইন্টারনেট দায়ী নয়, দায়ী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার : গোটা বিশ্ব যেখানে ইন্টারনেটের বদৌলতে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকতে পারে না। আর পিছিয়ে নেইও। ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝিতে প্রথম ইন্টারনেটের সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা ঘটে। প্রাথমিকভাবে টি এন্ড টি বোর্ড, আই এস এন, রয়টারসহ মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ভিস্যাট স্থাপনের অনুমতি প্রদান করে। বাংলাদেশের প্রায় সাতশত সদস্য ইতোমধ্যে ইন্টারনেটের ব্যবহার চালু করেছে।
উপসংহার : বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উপহার ইন্টারনেট। ইন্টারনেট বিশ্বের এক প্রান্তের মানুষের সাথে অন্য প্রান্তের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা অভাবনীয়রূপে সহজ করে দিয়েছে, বলতে গেলে গোটা বিশ্বকে একটি পরিবারে পরিণত করেছে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বে এর ছোঁয়া লাগলেও মাত্রা খুবই কম। আগামী দিনে ইন্টারনেটের ব্যবহারে উন্নত বিশ্বের সাথে আমরা তাল মিলাতে পারব আজকের দিনে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।