“জান্নাতের মাটি আর জমীন হচ্ছে জাফরান আর কস্তুরীর। এর ছাদ হচ্ছে আল্লাহর আসন। শিলাখণ্ডগুলো মণিমুক্তোর। দালানগুলো সোনারূপায় তৈরি। গাছের শাখা-প্রশাখাগুলো সোনারূপার। ফলগুলো মাখনের চেয়ে নরম, মধুর চেয়ে মধুর। পাতাগুলো সবচেয়ে কোমল কাপড়ের চেয়েও কোমল। কিছু নদী দুধের। যার স্বাদ কখনো বদলায় না। কিছু শরাবের। যারা পান করবে তাদের তৃপ্তি মিটবে। কিছু নদী পবিত্র মধুর। কিছু নদী সতেজ পানির। যে-ফলমূল তারা চাইবে তা-ই তাদের খাবার। যে-পাখির গোশত তারা খেতে চাইবে তা-ই পাবে। তাদের পানীয় হচ্ছে তাসনীম, সজীবতা উদ্দীপক ও কাাফূর। তাদের পেয়ালাগুলো স্বচ্ছ, সোনারূপার তৈরি। এর ছায়া এত বড় যে, দ্রুতগতির কোনো অশ্বারোহী এক শ বছর ধরে চললেও সেই ছায়া থেকে বের হতে পারবে না। এর বিশালতা এত বেশি যে, জান্নাতের সবচেয়ে নিচু অবস্থানে যে থাকবে তার রাজত্বে যেসব দেওয়াল, ভবন আর বাগান থাকবে সেগুলো পার করতে হাজার বছর লেগে যাবে। এর তাঁবু আর শিবিরগুলো যেন লুকোনো মুক্তো। একেকটা প্রায় ষাট মাইল লম্বা।
এর ভবনগুলোতে রুমের উপর রুম। তাদের নিচ দিয়ে নদী বয়ে যায়। এগুলোর উচ্চতা যদি জানতে চান তাহলে আকাশের যেসব উজ্জ্বল তারা দেখা যায় সেগুলোর দিকে তাকান। দৃষ্টি যেসব তারার নাগাল পায় না সেগুলোও দেখার চেষ্টা করুন। জান্নাতবাসীর পোশাক হচ্ছে রেশম আর স্বর্ণ। তাদের বিছানায় যেসব কাঁথা থাকবে সেগুলো হবে সবচেয়ে উঁচু মাপের রেশমি কাপড়ের। তাদের চেহারা হবে চাঁদের মতো। তাদের বয়স হবে ৩৩। মানবজাতির পিতা আদামের অবয়বে। সেখানে তারা শুনবে তাদের পবিত্র স্ত্রীদের গান। তার চেয়েও ভালো হচ্ছে সেখানে তারা ফেরেশতা আর নাবিদের কণ্ঠ শুনতে পাবে। এর চেয়েও ভালো হচ্ছে সেখানে তারা নিখিল বিশ্বজগতের প্রভুর কথা শুনতে পাবে। তাদের খেদমতে থাকবে চিরতরুণ বালকেরা। তাদের নমুনা হচ্ছে ছড়ানো-ছিটানো মুক্তোদানার মতো।
তাদের স্ত্রীরা হবে পূর্ণ-যৌবনা। তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গে যৌবনের উন্মাদনা ছড়াতে থাকবে। সে যদি তার সৌন্দর্য দেখায় তাহলে মনে হবে চেহারায় যেন সূর্য খেলে গেল। তার হাসিতে আলো চমকে উঠবে। তাদের ভালোবাসা হবে দুই আলোর মিলন। কোনো স্বামী যখন তার স্ত্রীর দিকে তাকাবে তার গালে নিজের চেহারার প্রতিচ্ছবি দেখবে। যেন কোনো উজ্জ্বল আয়নায় তাকিয়ে আছে। তার পেশি আর হাড়ের পেছন থেকে দ্যুতি ঠিকরে পড়বে। সেই স্ত্রী যদি দুনিয়াতে তার সৌন্দর্য অবারিত করত, তাহলে পৃথিবী ও মহাবিশ্বের মাঝে যা কিছু আছে সবকিছু সুন্দর বায়ু দিয়ে পূর্ণ হয়ে যেত। সব সৃষ্টি তার প্রশংসা করত, গুণকীর্তন করত। পূর্ব-পশ্চিম সব তার সৌন্দর্যে অলংকিত হতো। সব চোখ কেবল তারই দিকে ফিরে থাকত। সূর্যের আলোয় যেমন তারার আলো হারিয়ে যায়, তার সৌন্দর্যে সূর্য সেভাবে হারিয়ে যেত। পৃথিবীর বুকে সবাই তখন চিরঞ্জীব সেই মহান সত্ত্বা এক আল্লাহয় বিশ্বাসী হতো।" ( ইবনুল-ক়ায়্যিম)
"জান্নাতের প্রতিটি আনন্দ টেকসই। দিন দিন আনন্দের মাত্রা শুধু বাড়তেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে আর বাড়তেই থাকবে। জান্নাতের ফল-ফলাদি খেতে খেতে কখনো একঘেয়েমি এসে যাবে না। জান্নাতের পানীয় পানেও কখনো বিরক্তি এসে যাবে না। কারণ, এগুলো কখনো একরকম থাকবে না। সবসময় আগেরবারের চেয়ে উত্তম হবে। আবার খেলে আগের চেয়ে সুস্বাদু লাগবে। দুনিয়াতে সবকিছুর একটা সীমা আছে। একটা পর্যায়ে আসার পর আর ভাল্লাগে না। কিন্তু, জান্নাতে প্রতিটি আনন্দ সবসময় বৃদ্ধি পেতে থাকবে।" (নোমান আলী খান)
"সূরা ইনসানে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, وَ اِذَا رَاَیۡتَ ثَمَّ رَاَیۡتَ نَعِیۡمًا وَّ مُلۡکًا کَبِیۡرًا — যদি সে দেখত, যদি সে তার চারদিকে তাকিয়ে দেখত, সাম্মা রাআইতা, তাহলে সে দেখত, সে কী দেখত? 'নায়িমান' শুধু নেয়ামত আর নেয়ামত। 'নায়িম' হলো নি'মার বহুবচন। তার চারপাশের সবকিছু তাকে শুধু আনন্দ আর সুখ দিবে। এরপর এটা খুবই ইন্টারেস্টিং একটি বাক্যাংশ। 'ও মুলকান কাবিরা', এবং সুবিশাল এক রাজত্ব। বিশাল এক রাজত্ব। আমাদের সবাই জান্নাতে একজন রাজার মত হবে। আমাদের প্রত্যেকে একজন রাজার সমান রাজত্ব পাবে। আর এটা এতো বিশাল হবে যে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আমারটা শুধু আমারই হবে। ও মূলকান কাবিরা। সুবিশাল এক রাজত্ব শুধু আমার জন্য।
তো, একবার চিন্তা করে দেখুন, আমাদের প্রত্যেকের যদি একটা রাজত্ব থাকে... এর সাথে আরেকটি হাদিসের মিল রয়েছে যা আমি অনেক আগে বর্ণনা করেছিলাম। জান্নাতে সবচেয়ে কম সম্পত্তি যাকে দেয়া হবে, সে দশটা পৃথিবীর সমান বা অন্য বর্ণনামতে দশটি রাজত্বের সমান রাজত্ব পাবে। এমন এক ব্যক্তি, যে সবার শেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে, সে দশটা পৃথিবীর সমান সম্পদ পাবে। তাহলে ভেবে দেখুন, যারা সর্বোচ্চ লেভেলের জান্নাত আশা করে তাদেরকে কত বেশি দেওয়া হবে। আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করুন। কল্পনা করে দেখুন, কত ধরণের জমিন থাকবে সেখানে। কল্পনা করে দেখুন, কত ধরণের আনন্দ সে উপভোগ করবে। কল্পনা করে দেখুন, কত রকমের সম্পদ সেখানে থাকবে।" (ইয়াসির কাদি)
"জান্নাত যেহেতু একটি বাস্তব জায়গা তাই এটি কেবল বাস্তব প্রচেষ্টার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যোগ্যতা কখনোই হঠাৎ করে আসে না। ভালোর যে যোগ্যতাগুলো আপনার জন্য জান্নাত নিশ্চিত করবে তা কখনো স্বপ্নযোগে পাওয়া যাবে না। এর জন্য প্রচেষ্টার দরকার, বুদ্ধিমান প্রচেষ্টা। বুদ্ধিমান প্রচেষ্টা মানে আপনি ভালোভাবে শিখবেন এবং জানবেন কোন কোন কাজগুলো আপনাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। তারপর সে অনুযায়ী নিয়মিত কাজ করে যাবেন। এভাবেই আপনি জান্নাতে যাওয়ার যোগ্যতাগুলো অর্জন করতে পারবেন।
জান্নাত পেতে হলে মানুষকে পরীক্ষা দিতে হবে এবং সেসব পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে হবে। এ জন্য সমগ্র কুরআন মানুষের চেষ্টা সাধনা আর ত্যাগ তিতিক্ষার বর্ণনায় ভরপুর। কুরআনে জান্নাতের জন্য অনেক উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন - إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ۚ - "নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জীবন ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন।" (9:111) তাই আপনি যদি জান্নাত চান তাহলে আপনি আর আপনার জীবনের মালিক নন। আপনি যদি জান্নাত চান তাহলে আপনি আর আপনার ধন-সম্পদের মালিক নন। এগুলো সবই আল্লাহর মালিকানায়। অর্থাৎ, তাঁর রাসূলের দেখানো পথেই আপনাকে এগুলো ব্যয় করতে হবে। তবেই আপনি জান্নাত লাভ করতে পারবেন।" (আকরাম নদভী)
যদি জান্নাত না চান তাহলে দ্বিতীয় অপশন জাহান্নাম। এ ছাড়া আর কিছু নেই। শেষ বিচারের দিন কাউকে ছাড়া হবে না। প্রত্যেকের বিচার হবে।
"দুনিয়াতে আমাদেরকে যে শরীর দেয়া হয়েছে সে শরীর নিয়ে কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করতে পারবে না। সে বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। তাই আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা মানুষের শরীরকে নতুন ডিজাইনে তৈরী করবেন। এক নম্বর, মানুষ অনেক বড় আকৃতির হবে। হাদিসে এসেছে, জাহান্নামীদের দাঁত হবে ওহুদ পাহাড়ের সমান। মদিনায় গিয়েছেন কখনো? ওহুদ পর্বত দেখেছেন? সে ওহুদ পাহাড়ের সমান হবে আপনার দাঁত; শরীর নয়, আপনি নিজে নন। চামড়ার পুরুত্ব হবে তিন দিন ভ্রমণের দূরত্বের সমান। যেন আগুনের আজাব সামলাতে পারে। কিন্তু তারপরেও আপনার শরীর এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ টিকবে না। সেগুলো গলে যাবে। كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُودُهُمْ بَدَّلْنَاهُمْ جُلُودًا غَيْرَهَا لِيَذُوقُوا الْعَذَابَ - "যখনই তাদের চামড়াগুলো পুড়ে যাবে তখনই আমি তাদেরকে পালটে দেব অন্য চামড়া দিয়ে যাতে তারা আস্বাদন করে আযাব।" (সূরা নিসা আয়াত ৫৬।)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জাহান্নামে মানুষকে অবসর নেয়ার কোন সুযোগ দিবেন না। কোন অবসর নেই। فَذُوقُوا فَلَن نَّزِيدَكُمْ إِلَّا عَذَابًا - “অতএব, তোমরা আস্বাদন কর, আমি কেবল তোমাদের শাস্তিই বৃদ্ধি করব।” (78:30) কখনোই একরকম নয়। এটা কখনোই একরকম হবে না। প্রতিদিন নতুন ধরণের শাস্তি, নতুন ধরণের ব্যথা। চামড়া জ্বলে গেলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নতুন চামড়া দিবেন। সর্বদা কষ্টের পর কষ্ট, কষ্টের পর কষ্ট। আর এই কষ্ট সবসময় বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কোন বিশ্রাম নেই, কোন আশা নেই।
এর তাপ অসহনীয়। গভীরতা অনেক। জাহান্নামের অলংকার হলো শিকল। পানীয় হলো তীব্র গরম পানি। وَإِن يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ ۚ - "যদি তারা পানীয় প্রার্থনা করে, তবে পুঁজের ন্যায় পানীয় দেয়া হবে যা তাদের মুখমন্ডল দগ্ধ করবে।" (18:29)
শয়তানের এই ওয়াদায় কোনো বিশ্বাস রাখবেন না যে- 'এটা অনেক দূরের ব্যাপার, এটা কখনো ঘটবে না।' আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি - আপনি বিপদে আছেন! আল্লাহর শপথ! কেউ নিরাপদে নেই।"